ডাঃ বতুল রহমান জনসাধারণকে উদ্দেশ্য করে বলেন করোনা ভাইরাস একটা মারাত্মক প্রাণঘাতী ভাইরাস যা অতিশয় ছোঁয়াচে। একজন মানুষের কাছ থেকে অন্য মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত গতিতে। এর ফলে পুরো বিশ্বে লাখে লাখে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, মারা যাচ্ছে হাজারে হাজার।
এই রোগটি সর্বপ্রথম ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের উহান শহরে শনাক্ত হয়।পরবর্তীতে ২০২০ সালের প্রারম্ভে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং বৈশ্বিক মহামারীর রূপ ধারণ করে।
অতিরিক্ত শারীরিক দুর্বলতা, জ্বর, শুকনো কাশি, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট ও গুরুতর ক্ষেত্রে ফুসুফুস প্রদাহ (নিউমোনিয়া) এবং বিভিন্ন অঙ্গের বিকলতাও দেখা যায়।
অনেকেই এভাবে বলে থাকেন যে, প্রথম লক্ষণ হচ্ছে জ্বর, তারপর দেখা দেয় শুকনো কাশি, পরে শ্বাসকষ্ট।না, আসলে এগুলো তথ্য সঠিক নয়। উপসর্গ সমুহের যে কোন একটা উপসর্গ বা একাধিক উপসর্গ দেখা দিতে পারে। আবার কোন উপসর্গ নাও দেখা দিতে পারে।
তিনি আরো বলেন এই ভাইরাস মানুষের শরীরে ঢোকার পর দুই থেকে চৌদ্দ দিনের মধ্যে তার উপসর্গ দেখা দিবে।যদি কোন উপসর্গ দেখা না দেয় তবে চৌদ্দ দিন পরে এই ভাইরাস শরীরের মধ্যেই আপনা আপনি মরে যাবে।যদি উপসর্গ দেখা দেয়, তখন ভাইরাসের মিউটেশন, কোষ বিভাজন বা সংখ্যা বাড়তে থাকে।
মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকলে, এ ভাইরাস শরীরের ক্ষতি বেশি করতে পারে না।কিন্তু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে, বিশেষ করে Immuno-compromising অসুখগুলো যেমন, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার, অস্থি প্রদাহ ইত্যাদি থাকলে আক্রান্ত হবার বেশি সম্ভাবনা থাকে।আবার বয়স্কদের সংক্রমিত হবার ভয় বেশি।বাচ্চাদেরও ঝুকি আছে।
করোনা ভাইরাস এক রহস্যময় ভাইরাস।যার গতিবিধি এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ পরিস্কার নয় যে এটা কিভাবে এত দ্রুত ব্যাপকভাবে ছড়াচ্ছে।তবে বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, এ ভাইরাসটি একজন মানুষের দেহ থেকে আরেকজন মানুষের দেহে দ্রুত ছড়াতে পারে। প্রধানতঃ মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমেই এটি একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে ছড়ায়।খাদ্যনালীকেও সংক্রমিত করে।
এটি মানুষ ছাড়াও বিভিন্ন পশু যেমন বাঘ, বিড়াল, উট ও বাদুড়ের মধ্যে দেখা যায়।
সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার এই যে, একজন মানুষের শরীরে এই ভাইরাস সংক্রমিত হলে তা সংগে সংগে রোগের উপসর্গ গুলি প্রকাশ পায় না।প্রকাশ পায় ২-১৪ দিনের মধ্যে, আবার উপসর্গের প্রকাশ নাও পেতে পারে।ঠিক এই সময়েই সে যতজনের সংস্পর্শে আসবে, সবার মধ্যে সংক্রমিত হবে।আবার যিনি সংক্রমিত হলেন, তিনি বুঝতেও পারলেন না যে সংক্রমিত হলেন। তার সমস্যা হয়ত পরবর্তী ১০-১৪ দিনে প্রকাশ পাবে।ঠিক এই সময়ে তিনিও আবার কয়েকজনকে ছড়াবেন।এভাবেই লাখে লাখে সংক্রমিত হচ্ছে পুরো পৃথিবীতে।এখানেই এই ভাইরাসের ভয়ংকর রূপ।
এই ভাইরাস প্রধানতঃ হাত, চোখ, নাক, মুখ দিয়ে কণ্ঠনালী, শ্বাসনালীতে ঢুকে।প্রধানত শ্বাসযন্ত্রকে আক্রান্ত করে। খাদ্যতন্ত্রকেও আক্রান্ত করতে পারে।আবার আক্রান্ত মানুষের কাছ থেকে হাঁচি, কাশি, থুথুর মাধ্যমে অন্যের কাছে ছড়ায়। একজন যখন হাঁচি বা কাশি দেয়, তখন ভাইরাস গুলো হাঁচি, কাশির সাথে বের হয়ে আসে। বেশিরভাগ ভাইরাস তার গায়ের উপরে পড়ে, কিছু অংশ নিচে মাটিতে পড়ে, কিছু অংশ সামনের দিকে বাতাসে ভেসে যায়। তাই কাছাকাছি কেউ থাকলে সে তৎক্ষণাৎ আক্রান্ত হবে। বলা হচ্ছে ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত এই ভাইরাস বাতাসে ভেসে থাকতে পারে।ধারনা করা হচ্ছে, এই ভাইরাস বিভিন্ন বস্তু সামগ্রীর উপর ৩ ঘণ্টা থেকে ৩ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
করোনা ভাইরাস সংক্রামিত ব্যক্তি ঘরের বাইরে গিয়ে মুখ না ঢেকে হাঁচি-কাশি দিলে ভাইরাস তার আশেপাশের (১-৩ মিটার পরিধির মধ্যে) বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং কয়েক ঘন্টা বাতাসে ভাসমান থাকতে পারে।সেই করোনাভাইরাস কণাযুক্ত বাতাসে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করলে অন্য ব্যক্তিদের শ্বাসনালী দিয়ে করোনা ভাইরাস ফুসফুসে প্রবেশ করতে পারে।
করোনা ভাইরাস সংক্রামিত ব্যক্তি যদি কাশি শিষ্টাচার না মানেন, তাহলে তার হাতে বা ব্যবহৃত বস্তুতে করোনাভাইরাস লেগে থাকবে।এখন যদি উক্ত ব্যক্তি তার পরিবেশের কোথাও যেকোনো বস্তু স্পর্শ করেন, তাহলে সেই বস্তুর উপরে বা পৃষ্ঠতলে করোনাভাইরাস লেগে যাবে এবং পরবর্তী একাধিক দিন লেগে থাকতে পারে।তখন যদি অন্য কোনও ব্যক্তি সেই করোনাভাইরাস যুক্ত বস্তু কিংবা পৃষ্ঠ তলে হাত দিয়ে স্পর্শ করে, তাহলে ঐ নতুন ব্যক্তির হাতে করোনা ভাইরাস লেগে যাবে।হাতে লাগলেই করোনা ভাইরাস দেহের ভেতরে বা ফুসফুসে সংক্রমিত হতে পারে না, যদি তার সদ্য-করোনা ভাইরাস যুক্ত হাতটি দিয়ে নাকে, মুখে বা চোখে স্পর্শ করে, কেবল তখনই করোনাভাইরাস শরীরের ঐসব উন্মুক্ত শ্লেষ্মাঝিল্লী দিয়ে দেহের ভিতরে প্রবেশ করবে। প্রথমে গলায় ও পরে ফুসফুসে বংশবিস্তার করা শুরু করবে ও ফুস্ফুসে প্রদাহ সৃষ্টি করবে।ফুসফুসে এলভিওলাই এর সংক্রমণ বৃদ্ধির ফলে শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং মৃত্যু ঘটতে পারে।
* সর্বপ্রথম সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, যেহেতু পরীক্ষা ছাড়া আগে থেকে জানার কোনো উপায় থাকে না যে কে আক্রান্ত, কে আক্রান্ত নয়।
* আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে ন্যূনতম ৩ থেকে ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, যাতে বাতাসে ভাসমান ভাইরাস কণা শ্বাসগ্রহণের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করতে না পারে।
* সাবান পানিতে হাত ঘষে ঘষে প্রায় (২০-৩০) সেকেন্ড ধরে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করা। প্রয়োজনে সেনিটাইজার ব্যবহার করতে হবে।
*ঘন ঘন অথবা অহেতুক নাক, মুখ ও চোখ হাত দিয়ে স্পর্শ না করা।
* পরিবেশ পরিষ্কার করে করোনা ভাইরাস মুক্ত রাখা।
* সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করা জরুরী। বিশেষ করে বাইরে গেলে অবশ্যই সার্জিক্যাল মাস্ক, গ্লোভস ব্যবহার করতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মী বা যারা এই রোগীদেরকে নিয়ে কাজ করবে, তাদেরকে অবশ্যই সম্পূর্ণ সুরক্ষা নিতে পি,পি,ই ( Personal Protection Equipment) ব্যবহার করতে হবে।
* রাস্তায় ও যত্রতত্র থুথু ফেলা যাবে না, কেননা থুথু থেকে ভাইরাস ছড়াতে পারে।
* হাঁচি-কাশি দেওয়া ব্যক্তিকে অবশ্যই কাশি বা হাঁচি দেওয়ার সময় অস্থায়ী কাগজের রুমাল বা টিস্যুপেপার দিয়ে নাক-মুখ ঢাকতে হবে এবং সেই কাগজের রুমাল সাথে সাথে বর্জ্যে ফেলে দিতে হবে। খালি হাত দিয়ে কাশি-হাঁচি ঢাকা যাবে না, কেননা এর ফলে হাতে জীবাণু লেগে যায় (হাত দিয়ে হাঁচি-কাশি ঢাকলে সাথে সাথে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে)। কাগজের রুমাল না থাকলে কনুইয়ের ভাঁজে বা কাপড়ের হাতার উপরের অংশে মুখ ঢেকে হাঁচি-কাশি দিতে হবে।
* পরিচিত কারও করোনা ভাইরাসের লক্ষণ-উপসর্গ দেখা গেলে সাথে সাথে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বা জরুরী ফোনে যোগাযোগ করতে হবে যাতে তাকে দ্রুত পরীক্ষা করানো যায় এবং প্রয়োজনে সঙ্গ নিরোধ (কোয়ারেন্টিন) করে রাখা যায়।
* শ্বাসকষ্ট হলে নিবিড় পর্যবেক্ষণ এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
* করোনা আক্রান্ত যে কোন ব্যক্তির প্রতি সাহস জোগানো, মমত্ববোধ ও সদয় আচরণ করা উচিত।
প্রথম কথা, এই রোগে অন্য স্বাভাবিক ভাইরাসের চিকিৎসার মতই উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা।করোনার টেস্ট RT – PCR পরীক্ষা করে যদি পজিটিভ হয়, এবং আক্রান্ত ব্যাক্তির যদি শ্বাসকষ্ট না থাকে, তবে তাকে বাসাতেই চিকিৎসা দেয়া যাবে এবং অন্যদের থেকে আলাদা (আইসোলেশন) হয়ে থাকতে হবে।হাসপাতালে যাবার প্রয়োজন হবে না। যদি শ্বাসকষ্ট থাকে তবে তাকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।প্রয়োজনে আইসিইউ, এবং কৃত্তিম শ্বাসযন্ত্রের সাহায্য লাগবে।
এক্ষেত্রে স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি, প্রোটিন জাতীয় খাবার, লেবু বা কমলালেবু, কালোজিরা, রসুন খেলে শরীরের শক্তি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।কাশি বা গলাব্যথা থাকলে, গরম-লবন পানিতে গরগরা করতে হবে।
বিশ্ব জুড়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণে করোনা ভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।যেহেতু কোভিড-১৯ এর কোন সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা, টিকা কিংবা নির্দিষ্ট ভাইরাস নিরোধক নেই, সেজন্য পৃথিবী জুড়ে মৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে। তাই এ মহামারী থেকে বাঁচতে হলে, মানব জাতিকে বাঁচাতে হলে, ব্যাক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও বিশ্ব ব্যাপী সম্মিলিত প্রচেষ্টার দ্বারা সচেতনতা সৃষ্টি করে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে এবং মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ প্রতিরোধ-ই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ।
করোনা ভাইরাসের হাত-পা নেই, সে একা চলতে পারেনা, মানুষের মাধ্যমে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যায় এবং সংক্রমণ ঘটায়। সুতরাং মানুষকেই সচেতন হতে হবে। করোনা মুক্ত থাকার একমাত্র উপায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। আর এর জন্যে কোন ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত হলে তাকে আলাদা হয়ে থাকতে হবে।
যখন কেউ পরিবার থেকে, বন্ধু, সহকর্মী থেকে আলাদা হয়ে পড়ছেন, তখন সে ব্যক্তি ভীষণভাবে ঘাবড়ে যাচ্ছেন। অজানা আতঙ্কে অস্থির হয়ে পড়ছেন।আরও বেশি সমস্যা হয় যে, শরীর অসম্ভব রকমের দুর্বল হয়ে পড়ে। নড়াচড়া পর্যন্ত করতে পারেন না।কখনও এই আতংকেই অনেকে মৃত্যু বরণ করছেন।
করোনা আমাদের কাছ থেকে অনেক স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মীকে কেড়ে নিয়েছে, আবার পাশাপাশি শিখিয়ে দিচ্ছে সমগ্র সৃষ্টির কাছে আমরা কত ক্ষুদ্র আর কত অসহায়।মহান আল্লাহ্ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া আর কোন দ্বিতীয় পথ খোলা নেই আমাদের।তিনি যেন এই ভয়ংকর করোনা মাহামারি থেকে মানব জাতিকে রক্ষা করেন।