রাত তখন ৪টা বেজে একচল্লিশ মিনিট। ওসি সাহেবের মোবাইল বেজে ওঠে রিং টোনের শব্দে। ঘুম চোখেই ফোন রিসিভ করে জানতে পারেন পৌরসভার এক বাসায় ডাকাতি হয়েছে। গৃহকর্তা ডাকাতদের হাতে খুন হয়েছে এবং গৃহকর্তী ডাকাতের ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সাড়ে তিনটার সময় ওসি সাহেব থানার টহল ডিউটি তদারকি করে ফিরেছেন বাসায়। এক ঘন্টা যেতে না যেতে ঘুম চোখেই থানার সকল টহল দলকে নির্দেশনা দেন ঘটনাস্থলে দ্রুত যেতে। নিজেও ছুটে যান ঘটনাস্থলে। ঘরে খাটের উপর পড়ে আছে গৃহকর্তার নিথর দেহ। বুকে পাঁচটি ধারালো ছুরির আঘাতের চিহ্ন। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে বিছানা গেছে ভিজে। পাশেই পড়ে আছে রক্তাক্ত ছুরি। ছোট্ট তিনটি শিশু সন্তান কাঁদছে বাবার মৃত দেহ দেখে। উপস্থিত লোকজন হাহুতাশ করছে, কেউবা শোকে কাঁদছে অঝোরে।
গৃহকর্তা মাহবুবুর রহমান(৩৮) কমলাপুর রেলস্টেশনের একজন কর্মচারী। থাকেন তেজগাঁও এলাকায় ব্যাচেলর বাসায়। বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক বন্ধ থাকায় ভৈরব পৌরসভার চণ্ডিবের উত্তর পাড়ায় নিজ বাসায় পরিবারের নিকট আসতেন প্রতি বুধবার সন্ধ্যায়। শুক্রবার ভোরে ফিরে যেতেন কর্মস্থলে। ছেলে আজিজুল(১০) ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র, সামিউল(৭) প্রথম শ্রেণির ছাত্র এবং মেয়ে সাদিয়া(৩) ছোট। মাহবুবুর রহমানের প্রথম স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ হয় ২০০৪ সালে। সে সংসারে কোন সন্তান ছিলো না। ২০০৮ সালে পারিবারিকভাবে বিবাহ করেন নরসিংদী জেলার বেলাবো থানার ইব্রাহিমপুর গ্রামের রোখসানাকে। সুখের সংসারে তিন সন্তান নিয়ে তাদের ভালোই কেটে যাচ্ছিল সময়। কিন্তু অকল্পনীয় এমন দুর্ঘটনায় তাদের সব স্বপ্ন ভেঙে যায়। অবুঝ তিনটি শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত আত্মীয়-স্বজন।
অন্য সপ্তাহের মতো ২৭ নভেম্বর বুধবার সন্ধ্যার পর বাসায় আসেন মাহবুবুর রহমান। রাত সাড়ে দশটার দিকে ঘুমিয়ে যান তিনি। রাত ৪টার পর ওসি সাহেব সংবাদ পেয়ে যখন ঘটনাস্থলে আসেন তখন বাড়ি ভর্তি স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থল ঘরের কোন মালামাল নেই এলোমেলো, ঘরের দরজা জানালা আছে অক্ষত। ডাকাতের ব্যবহৃত ছুরি ব্যতিত নেই অন্য কোন আলামত। দক্ষ ওসি জনাব মোঃ শাহীন খুঁজতে থাকেন নানা প্রশ্নের জবাব। কিন্তু উত্তর যে দিবে সে আছে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। গৃহকর্তী রোখসানার নিকট থেকে সেসব প্রশ্নের উত্তর জানতে ছুটে যান হাসপাতালে। অসুস্থ রোখসানা কিছু প্রশ্নের উত্তর দেন, কিছু প্রশ্ন এড়িয়ে যান। কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ততক্ষণে ওসি সাহেবের সন্দেহ আরও ঘনিভূত হয়েছে। ডাক্তারের পরামর্শে উন্নত চিকিৎসার জন্য রোখসানাকে রেফার করা হয় জহিরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ভাগলপুর, বাজিতপুরে। কৌশলে নিরাপত্তার কথা বলে রোখসানাকে নজরদারী করার জন্য দুইজন নারী ও একজন পুরুষ পুলিশ দেয়া হয় তার সাথে। চিকিৎসা ও নজরদারীতে থাকে রোখসানা।
অবস্থা বিবেচনায় দক্ষ ওসি জিডি মূলে গৃহকর্তার লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরী করেন এসআই মতিউজ্জামান। এরপর ময়না তদন্তের জন্য পাঠান হাসপাতাল মর্গে। সারাদিন চলে চুলচেরা বিশ্লেষণ। ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকের নিকট থেকে পেয়ে যান কিছু তথ্য। বিশ্বস্ত একাধিক সোর্স এবং তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় ঘটনা সম্পর্কে পেয়ে যান কিছু ধারনা। ২৮ নভেম্বর রাতে ভিকটিম মাহবুবুর রহমানের ভাই হাবিবুর রহমান অভিযোগকারী হিসেবে দায়ের করেন অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা। মামলা নং- ৬০, ধারা ৩০২/৩৪ পেনাল কোড। নজরদারীর আওতায় চলে আসে আরও কয়েকজন। ঘুম নেই তদন্তকারী অফিসার পুলিশ পরিদর্শক(তদন্ত) জনাব বাহালুল খান বাহারের চোখে। নানান তথ্য সন্নিবেশিত করে আগাতে থাকেন মূল ঘটনার দিকে। ৩০ নভেম্বর গ্রেফতার করা হয় গৃহকর্তী রোখসানাকে। নিবিড় জিজ্ঞসাবাদে বের হয়ে আসে ঘটনার মূল রহস্য। তার দেয়া তথ্য মতে গ্রেফতার করা হয় নজরদারীতে থাকা দেবর আসিফ আহম্মেদ(১৯)-কে। রান্না ঘর থেকে উদ্ধার করা হয় ঘটনায় ব্যবহৃত ঘুমের ঔষধ মেশানো প্লাস্টিকের বোতল এবং ঘুমের ঔষধের খোসা। আর আসিফের দেয়া তথ্যে কচু ক্ষেত থেকে উদ্ধার করা হয় ঘটনার সময় আসিফের গায়ে থাকা রক্তমাখা শার্ট ও প্যান্ট। ০১ ডিসেম্বর উভয় আসামি বিজ্ঞ আদালতে দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে জানিয়েছে ঘটনার আদ্যোপান্ত।
আসিফ আহম্মেদ স্থানীয় কলেজে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। সম্পর্কে ভিকটিম মাহবুবুর রহমানের আপন চাচাত ভাই। সে হিসেবে অপর আসামি রোখসানার দেবর। পাশাপাশি ঘরে বসবাস করায় তাদের মধ্যে ছিল অবাধ দেখাশোনা হওয়ার সুযোগ। মাহবুবুর রহমান সপ্তাহের ছয়দিন বাড়ির বাইরে থাকায় তাদের মধ্যে সম্পর্ক হতে থাকে ঘনিষ্ট। একসময় এ সম্পর্ক মন থেকে শরীরে গড়ায়। দুজন দুজনার প্রেমে মশগুল হয়ে যায় দিনদিন। রোখসানা ভালবেসে তার বিবাহের গহণা বিক্রি করে নগদ এক লক্ষ টাকাও দেয় আসিফকে বিদেশে যাওয়ার জন্য। এছাড়াও প্রায়ই সময় বিভিন্ন কারনে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা দিতে থাকে আসিফকে। নিজের তিন সন্তানের ভবিষ্যৎ এবং সামাজিক সকল বাঁধা উপেক্ষা করে অসম প্রেমে তারা যখন হাবুডুবু খাচ্ছিলেন তখনই মাথায় আসে এক কুবুদ্ধির হাতছানি। রোখসানা ইদানিং স্বামী মাহবুবুর রহমানকে দেখতে পারেনা দু’চোখে। মাহবুব বাসায় এলেই তার অস্বস্তি লাগে। সুখের সংসারে এখন নিয়মিত ঝগড়া এবং আলাদা বিছানায় রাত্রীযাপন। মাহবুব হয়তো বিষয়টি আঁচ করতে পারেনি বা আঁচ করলেও বুঝতে পারেনি ঘটনার মূল রহস্য। তবুও মাহবুবুর রহমান স্ত্রীর মন রক্ষা করতে প্রতি বুধবার ছুটে আসেন নিজ বাড়িতে।
রোখসানা এবং আসিফ এবার ছক আঁটে নতুন পরিকল্পনায়। তাদের অসম প্রেমের একমাত্র অন্তরায় মাহবুবকে সরিয়ে দিতে হবে পৃথিবী থেকে। দু’জনেই সম্মত হয় এ সিদ্ধান্তে। প্রথম চেষ্টা হিসেবে দুই সপ্তাহ আগে আসিফ ২০টি ঘুমের ঔষধ পানিতে গুলিয়ে বোতলে করে দিয়ে যায় রোখসানার নিকট। বুধবারে বাসায় এলে রাতে কফির সাথে মিশিয়ে রোখসানা সে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে দেয় স্বামী মাহবুবকে। রাতে প্রচুর নাক ডেকে ঘুমালেও সকালে ঘুম থেকে উঠে যায় মাহবুব। এ যাত্রা ভেস্তে যায় হত্যার পরিকল্পনা, বেঁচে যায় মাহবুব। দীর্ঘ বারো বছরের সংসারে স্ত্রী তাঁকে মেরে ফেলবে ঘুণ অক্ষরেও বুঝতে পারেনি সহজ সরল মাহবুব। যথারীতি সে ভালোবেসে যায় তার স্ত্রীকে। এর পরের সপ্তাহে একইভাবে বাসায় এলেও এবার ছিলো না কোন পরিকল্পনা। সুস্থ মতো ফিরে যায় কর্মস্থলে।
গত ২৭ নভেম্বর বুধবার বাসায় আসার আগেই রোখসানা এবং আসিফ আবার পরিকল্পনা করে মাহবুবকে হত্যার। ১০টি ঘুমের ঔষধ কিনে আনে রোখসানা আর ২০টি আনে আসিফ। ৩০টি ট্যাবলেট একসাথে গুড়ো করে একটি প্লাস্টিকের বোতলে পানিতে গুলিয়ে আসিফ দিয়ে যায় রোখসানার নিকট। স্বামী মাহবুব বাসায় এসে স্ত্রীর হাতে খেতে চায় সুস্বাদু পায়েস। ঘুমের ঔষধ মেশানোর মাধ্যম পেয়ে যায় রোখসানা। রাতের খাবার শেষে পায়েস রান্না করে স্বামীর পায়েসের পেয়ালায় মিশিয়ে দেয় ঘুমের ঔষধ মেশানো পানি। এবার পায়েস খেয়ে গভীর অচেতন ঘুমে মাহবুব। ছেলে মেয়েরা যায় ঘুমিয়ে। আসিফকে ম্যাসেজে জানায় অবস্থা। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে আসিফ আসে বাসায়। অবস্থা দেখে শুনে আবার ফিরে যায়। রাত সাড়ে বারোটায় আবার আসে আসিফ। এবার পরিকল্পনার ছক আঁকে দু’জনে। বালিশ চাঁপা দিয়ে হত্যা করা হবে মাহবুবকে। তারপর বলা হবে হার্ট এ্যাটাক হয়ে মারা গেছে মাহবুব। তবে কোন কারণে মাহবুব জেঁগে উঠলে প্রতিহত করা হবে ছুরি দিয়ে। বাসায় থাকা ছুরি এগিয়ে দেয় রোখসানা। তবে ছুরি দিয়ে আঘাত না করার পক্ষে রোখসানা। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষার কথা বলে ফিরে যায় আসিফ।
রাত তিনটার দিকে ফোনে কথা বলে আবার আসে আসিফ। বারান্দা থেকে দু’জনে কাপড় শুকানোর রশি এনে কম্বল পেঁচিয়ে মাহবুবের পা বেঁধে ফেলে। নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিল মাহবুব। এরপর আসিফ মাহবুবের বুকের উপর উঠে বসে। রোখসানা বসে পেটের উপর। মুখে বালিশ চাঁপা দিলে অচেতন অবস্থায়ই মাহবুব বালিশ সরিয়ে বলে ওঠে “কেরে?” ততক্ষনে আসিফ বুঝে নেয় তাঁকে চিনে ফেলেছে মাহবুব। সজোরে আঘাত করে বুকে ছুরি দিয়ে। তিনটি আঘাত করলে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয় শরীর থেকে। চতুর্থবার আঘাত করতে গেলে বাঁধা দেয় রোখসানা। ডান হাত কেটে যায় তার। আরও দুইটি আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। দু’জনের পরিকল্পনা তখন পরিবর্তন হয়। ডাকাত এসে হত্যা করে গেছে বলে প্রচার চালানোর উদ্যোগ নেয় তারা। পরিহিত রক্তমাখা কাপড় ফেলে দিয়ে গোসল করে পরিস্কার হতে বের হয়ে যায় আসিফ। মাদ্রাসার পাশে কচু ক্ষেতে লুকিয়ে রাখে রক্তমাখা প্যান্ট ও শার্ট। এরপর খবর রটে দেয়া হয় ডাকাতির ঘটনার।
মাত্র দুই দিনের মধ্যে ক্লু-লেস এ হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য উদঘাটন করে ভৈরব থানা পুলিশ অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মুখোশ উন্মোচন করেছে অসম প্রেমের অনৈতিক সম্পর্কের। এমন ঘটনা আর দ্বিতীয়টি না ঘটে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা হোক আদালতের মাধ্যমে, এ চাওয়া আমাদের সকলের। তিনটি অবুঝ সন্তান বাবা-মা হারানোর বেদনা সইবার শক্তি পাক এ কামনাও আমাদের। চৌকস পুলিশের এমন কাজে সাধুবাদ জানিয়েছেন সুধীজন। ধন্যবাদ ও শুভ কামনা তদন্ত সংশ্লিষ্ট টিমকে।
ছবিতে গ্রেফতারকৃত আসামি এবং ইনসেটে ভিকটিম
তথ্য সংগ্রহ ও লেখা- হাফিজুর রহমান
উপ-পুলিশ পরিদর্শক, ঢাকা রেঞ্জ মিডিয়া
সূত্র : জেলা পুলিশ, টাঙ্গাইল District Police Tangail পেজ থেকে নেয়া