কলাপাড়া (পটুয়াখালী) প্রতিনিধিঃ একটি শ্রেণিকক্ষে ৩ জন শিক্ষার্থী নিয়ে চলছে পাঠদান। বিদ্যালয়ের বাকি কক্ষগুলো পড়ে আছে ফাঁকা। একই পরিবারের তিনজন শিক্ষক। একজন আসলে, আরেকজন আসেন না। প্রধান শিক্ষক মাঝে মাঝে এসে হাজিরা খাতায় এক সপ্তাহের স্বাক্ষর একদিনে দেন। বলছিলাম পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধুলাসার ইউনিয়নের ১২৮নং চর ধুলাসার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা।
গত কয়েক বছর ধরে প্রতি শিক্ষাবর্ষে ৫-১০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে এভাবে চলে আসছে বিদ্যালয়টির পাঠদান কার্যক্রম। স্থানীয়রা বলছেন, বিদ্যালয়টির শিক্ষকদের অশোভন আচরণ, অনুপস্থিতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে এমন পরিস্থিতি। ম্যানেজিং কমিটি কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ, মনগড়া ও নিজেদের খেয়াল খুশিমতো চালাচ্ছেন পাঠদান। বিদ্যালয়ের সামনে বড় করে একক প্রতিষ্ঠান লিখে, ঠিক যেন একক আধিপত্যই বিস্তার করেন। সরেজমিনেও মিলেছে এসবের সত্যতা।
রোববার (২৭ অক্টোবর) সরেজমিনে বিদ্যালয়টি ঘুরে দেখা গেছে, সকাল সাড়ে ৯ টায় সরকারি নিয়মানুসারে প্রাথমিকের পাঠদান চলার কথা থাকলেও এসব নিয়ম-নীতির কোনো তোয়াক্কা না করে নিজস্ব নিয়মে চলছে বিদ্যালয়। ১০ টার সময় ক্লাসে আসেন সহকারী শিক্ষক জাহাঙ্গীর। আকলিমা নামের এক শিক্ষিকা সেও ১০ টার কিছু পরে আসেন। সাড়ে ১০ টার দিকে গুটি গুটি পায়ে বিদ্যালয় প্রবেশ করেন প্রধান শিক্ষক আল-আমিন বিশ্বাস। ওই সময় বিদ্যালয়ের প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সব শ্রেণিকক্ষ শিক্ষার্থীশূন্য। সাংবাদিক দেখে তড়িঘড়ি করে অফিস কক্ষে ঢুকে বিগত কয়েক দিনের স্বাক্ষর একসাথে করেন সহকারী শিক্ষিক জাহাঙ্গীর ও আকলিমা। তবে হাজিরা খাতায় গত কয়েকদিন প্রধান শিক্ষকের অনুপস্থিতি দেখা গেছে। আরেক সহকারী শিক্ষক সাওদাও রয়েছেন ছুটিতে। তবে ছুটির কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি প্রধান শিক্ষক।
সহকারী শিক্ষক জাহাঙ্গীর বিদ্যালয়ের নিচে কয়েকজনকে ডেকে শিক্ষার্থী সাজিয়ে প্রথম শ্রেণির কক্ষে ঢুকিয়ে বেঞ্চে এনে বসান। তখনও বিদ্যালয়ের প্রাক-প্রাথমিক থেকে অপর কক্ষগুলো শিক্ষার্থীশূন্য। বিদ্যালয়ে ৫ জন শিক্ষকের বিপরীতে উপস্থিত ছিলেন ৩ জন। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মোট উপস্থিত ছিল ১১ জন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ঠিকমতো আসেন না। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত কোনো ক্লাস না নেওয়ায় গত ৭-৮ বছর ধরে স্কুলটি একেবারেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার পালা। শিক্ষকরা অনিয়মিত হওয়ার কারণে বিদ্যালয়টিতে কমতে থাকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। অভিযোগ রয়েছে একই ফ্যামিলির প্রধান শিক্ষকসহ তিনজন থাকায় তারা পালা বদল করে ক্লাস নিচ্ছে। বাবা আসলে মেয়ে আসে না, মা আসলে বাবা আসে না। এ যেন চোর পুলিশের খেলা খেলছে শিক্ষার্থীদের সাথে। যার ফলে এখানে বাচ্চাদের দিলে তাদের লেখাপড়ার কোনো উন্নতি হয় না, তাই বাধ্য হয়ে তাদের অন্যত্র নিয়ে যেতে হয়, এমন অহরহ অভিযোগ উঠেছে।
সজীব তালুকদারসহ স্থানীয় একাধিক অভিভাবকরা বলেন, ‘সব অনিয়মের অবসানের মাধ্যমে ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পদচারণায় সুন্দর ও স্বাভাবিক পাঠদানের মধ্যদিয়ে আবারো মুখরিত হয়ে উঠুক। আমরা এমনটাই প্রত্যাশা করি।’
অভিভাবক সদস্য মোহাম্মদ সুফিয়ান তালুকদার আক্ষেপ করে বলেন, ‘শিক্ষকরা ঠিকমতো ক্লাসে আসে না, ৯ টার সময় আসার কথা থাকলেও তারা কখনো ১০ টা কখনো ১১ টায় আসেন। তারা ঠিকমতো ক্লাস নেয় না। প্রধান শিক্ষক, তার মেয়ে-স্ত্রীসহ একই পরিবারের তিনজন। তারা একদিন এসে দুই-তিন দিনের সই একবারে দিয়ে চলে যায়। আমরা চাই প্রতিষ্ঠানটি সঠিকভাবে চলুক।’
স্থানীয় লিটন হোসেন তালুকদার বলেন, ‘শিক্ষকদের অনিয়মের কারণে আজ বিদ্যালয়টি প্রায় শিক্ষার্থীশূন্য হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষকদের স্থায়ীভাবে এখান থেকে অপসারণ না করলে তারা তাদের বাচ্চাদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করবেন না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক অভিযোগ করে বলেন, ‘গত এক বছর আগে তার ছেলেকে এ বিদ্যালয়ে এনে ভর্তি করেন। কিন্তু গত এক বছরে সে এখনো পর্যন্ত বই দেখে রিডিং পড়তে পারে না। বর্তমানে বিদ্যালয়ে কাগজে-কলমে মোট শিক্ষার্থী ১১৭ জন। কিন্তু প্রতিদিন গড়ে ১০-১২ জন উপস্থিত হয়। শিক্ষার্থী কম থাকায় অবসর সময় কাটাতে হয় শিক্ষকদের।’
সহকারী শিক্ষিকা আকলিমা বেগম তাদের অনিয়মের কথা স্বীকার করে প্রতিবেদককে নিউজ না করার জন্য অনুরোধ জানান।
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধান শিক্ষক আল-আমিন বিশ্বাস বলেন, আমি ও আমার স্ত্রী এবং মেয়ে একই প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করলেও কখনো ব্যক্তিগত প্রভাব খাটাইনি। শারীরিক অসুস্থ থাকার কারণে গত দুই দিন স্কুলে আসেননি। তবে ছুটি না নিয়ে অনিয়মের দায় শিকার করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, সহকারী শিক্ষিকা আকলিমা গত বৃহস্পতিবার স্কুলে আসেনি, রবিবার এসে স্বাক্ষর করার সুযোগ নেই। মেয়ে সাওদা সহকারী শিক্ষিকার অনুপস্থিতির বিষয় জানতে চাইলে ছুটিতে আছে বলে জানান। তবে ছুটির কাগজ দেখাতে পারেননি।
এ ব্যাপারে কলাপাড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা অচ্যুতানন্দ দাস বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনিয়ম করার সুযোগ নেই। আপনাদের মাধ্যমে বিষয়টি জেনেছি, সরেজমিন তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ‘অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. বখতিয়ার রহমান বলেন, ‘অতিদ্রুত বিষয়টি খতিয়ে দেখে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’