বিশ্বব্যাপী মহামারির রূপ পাওয়া নভেল করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) বিশ্বের ২১০ দেশ ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে দুই লাখ চুয়াল্লিশ হাজারেরও বেশি মানুষের। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই মৃতের সংখ্যা ৬৫ হাজার ছাড়িয়েছে। মৃত্যুর এই মিছিল দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। বাংলাদেশেও কিছু মাত্রায় সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েছে। এই অবস্থার মধ্যেই যে-যার অবস্থান থেকে আমরা করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবা না।’ সত্যিই বাঙালিদের দাবিয়ে রাখা যায়নি। একাত্তরে নিরস্ত্র বাঙালি জাতি সশস্ত্র পাকিস্তানিদের মোকাবেলা করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। তাদের দাবিয়ে রাখা যায় নি। আবার পঁচাত্তরের আগস্টের পনেরো তারিখ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে বাঙালি জাতিকে দাবিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র হলেও সেটাও যে কার্যত সফল হয়নি, তার বড় প্রমাণ আজকের বাংলাদেশ। রাষ্ট্রপিতাকে আমরা হারিয়েছি। কিন্তু জাতির গৌরব বিসর্জন না দিয়ে মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাওয়ার যে দীক্ষা তিনি আমাদের দিয়ে গেছেন সেটা সম্বল করে আমরা এখন বলতে পারি, কেউ আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী এই মহামারি মোকাবিলায় প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দিয়ে যেমন জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে, ছিনিয়ে এনেছিল একটি পতাকা, একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড। আজ তারই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে করোনাযুদ্ধেও আমরা জয়ী হব। বিশ্ব তাকিয়ে দেখবে অবাক বিষ্ময়ে।
যদিও পরিস্থিতি বলছে, করোনা দুযোর্গের নানামুখি প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হবে এবং এই লক্ষণও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ রূপ পাওয়া কোভিড-১৯ ভাইরাস আমাদের সামনে এখন এক বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। তবে আশার কথাও আছে। এরই মধ্যে করোনার জন্য দুটি কোম্পানি ওষুধ তৈরি করেছে। দেশে সহজ লভ্য এবং সস্তায় কয়েকটি আইসোলেটর ও ভেন্টিলেটরও তৈরি হচ্ছে—যা আগে আমরা কোনোদিন কল্পনাও করিনি। কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ জাতীয় অস্তিত্বের বিষয়। তাই মানুষের জীবন বাঁচাতে দ্রুত দৃঢ় ও সমন্বিত নীতিই পারে এই মহামারি থেকে আমাদেরকে সুরক্ষা দিতে।
করোনা মোকাবেলায় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যসহকারী, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, এমনকী যুদ্ধ করছে সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। সংক্রমণ ছড়ানো ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, রাস্তায় জীবাণুনাশক ছিটানো, শ্রমজীবী মানুষকে সহায়তা করা, সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণ করা, চিকিৎসা না পেয়ে থানায় হাজির হওয়াদের চিকিৎসা করা, মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, ঘরে থাকা মানুষের কাছে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য পৌঁছে দেওয়া, কোয়ারেন্টাইন থেকে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা, লকডাউন এলাকায় মানুষের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করাসহ করোনায় মৃতদের দাফনের ব্যবস্থাতেও থাকতে হচ্ছে পুলিশ বাহিনীকে। ঢাকাসহ সারাদেশে লাখের বেশি পুলিশ দিনরাত যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। সাথে সাথে সামরিক বাহিনীও করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এই যুদ্ধ করতে গিয়ে ইতোমধ্যে বহু পুলিশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন; মারাও গেছেন।
এদিকে, করোনায় আক্রান্তদের সেবা দিয়ে সুস্থ করার সম্মুখ যুদ্ধে আছেন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যসহকারীরা। দেশ-বিদেশের করোনা সংক্রান্ত সব তথ্য তুলে ধরে জনসচেতনায় দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন সাংবাদিকরা। এই যুদ্ধে নেমে চিকিৎসক এবং সাংবাদিকও মারা গেছেন। সুতরাং আমরা সবাই যার যার অবস্থান থেকেই করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি।
আবার মরণঘাতী এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে শিক্ষা-গবেষণার প্রায় সব শাখার সম্মিলিত প্রয়াস চলছে বিশ্বজুড়ে। সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে এবং নিচ্ছে। গবেষকরাও করোনা ঠেকাতে সামাজিক দূরত্বের উপর জোর দিয়েছেন।
একটি উদারহণ এখানে প্রাসঙ্গিক। তাহলো, যানবাহনের পেছনে আমরা প্রায়ই একটা বাক্য লেখা থাকতে দেখি, ‘১০০ হাত দূরে থাকুন’। মাঝেমধ্যে আমরা রাগের বশেই হোক বা মজা করেই হোক, একে অন্যকে বলি, ‘দূরে গিয়া মর!’ এসবের মূলকথাই হলো ‘দূরত্ব বজায় রাখুন’।
হ্যাঁ, দূরত্ব বজায় রাখুন, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলুন। এতে সংক্রামক বা ছোঁয়াচে রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়া রোধ করে। এ ক্ষেত্রে পরস্পরের মধ্যে ছয় ফুট বা প্রায় দুই মিটারের ব্যবধান বজায় রাখা বাঞ্চনীয়।
আর একটি উদাহরণ, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে অভিনব সাফল্য পেয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভিয়েতনাম। চীন সীমান্তঘেঁষা দেশটি ঘোষণা করেছে, কোভিড-১৯ আক্রান্তরা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন। প্রায় ৯ কোটির জনসংখ্যার ওই দেশটিতে করোনাভাইরাস রোগী পাওয়া গেছে ২৭০ জন; একজনও মারা যায়নি। বিশ্বে প্রতি মিলিয়নে আক্রান্তের সংখ্যা এ দেশেই সবচেয়ে কম। দেশটির প্রধানমন্ত্রী তবু জনগণকে সজাগ থাকতে বলেছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সব রোগীকে সুস্থ করে তোলায় ভিয়েতনামের চিকিৎসকদের ভূয়সী প্রশংসা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও।
ভিয়েতনাম সরকারিভাবে স্বাস্থ্য খাতের বিনিয়োগ ও রোগের চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধ করার যে কর্মসূচি বহুদিন ধরে চর্চা করে আসছে করোনা প্রতিরোধ সেটি বড় ঢাল হিসেবে কাজ করেছে। আর কোভিড-১৯ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার আগেই ভিয়েতনাম পুরো দেশটাই লকডাউন করে দিয়েছিল। এতে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়েছে।
চীনের উহান থেকে ফেরা ৬৬ বছর বয়সী এক ভিয়েতনামি প্রথম করোনাভাইরাসে শনাক্ত হন। আনুষ্ঠানিকভাবে ২৩ জানুয়ারি প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্তের খবর প্রকাশ করে ভিয়েতনাম সরকার। ওই দিন থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১৪ জনে। এর মধ্যে দুজন চীনা নাগরিক ছাড়া বাকি সবাই ভিয়েতনামি। ব্যাপক আকারে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে তখনই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয় সরকার। পাশাপাশি করোনা নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালায় সাধারণ মানুষের মধ্যে। কীভাবে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে, কী করলে সুস্থ থাকবে, এটাই ছিল প্রচারের মূল্য বক্তব্য। এসবের পাশাপাশি দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের খুঁজে খুঁজে পরীক্ষা করেছে। তবে গত ২ মার্চ সর্বনাশটা ঘটায় দেশটির একজন প্রভাবশালী নারী ব্যবসায়ী। ইউরোপের তিন দেশ ঘুরে ওই ব্যবসায়ী ভিয়েতনামের হ্যানয় বিমানবন্দরের দায়িত্বরত কর্মচারীদের দ্বারা পরিচালিত করোনা পরীক্ষা ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়েন দেশে।
বিমানবন্দরের পরীক্ষায় ফাঁকি দিলেও ভিয়েতনামের পুলিশ তাকে ঠিকই আটক করে। এরপর জানা যায়, তিনি করোনা আক্রান্ত। পরে, ভিয়েতনাম সরকার একটি বড় পদক্ষেপ নেয়। সেটি হলো—ওই নারী যে বিমানে এসেছিলেন, তার সব যাত্রীকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। তিনি যে রাস্তা দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই রাস্তা জীবাণুমুক্ত করা হয়, সেই পথের ধারে বসবাস করা প্রত্যেককে পরীক্ষা করা হয়। ভিয়েতনামের স্বাস্থ্য বিভাগ মনে করে, যদি ইউরোপফেরত নারী বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ফাঁকি না দিতেন, তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা এত বাড়ত না। তবে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানের তুলনায় ভিয়েতনাম এখন পর্যন্ত করোনা মোকাবেলায় যা করেছে, তা পুরো বিশ্বের জন্য অনুকরণীয়।
পরিশেষে বলতে চাই, ইউরোপ থেকে এশিয়া কিংবা অস্ট্রেলিয়া থেকে আমেরিকা—সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে করোনা। অতীতে কোনো যুদ্ধ সাধারণ মানুষকে এত উদ্বিগ্ন বা ভাবিয়ে তুলেছে কিনা জানা নেই। অথচ তিন মাসেরও কম সময়ে এই ভাইরাস বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে বিস্তার করে মানুষকে কাবু করে ফেলেছে। যে দেশেই ঢুকছে সে দেশকেই নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছে।
এ অবস্থায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করেন। আতঙ্কিত না হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন।
সুতরাং করোনা যুদ্ধে জয়ী হওয়ার হাতিয়ার হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। এ যুদ্ধে জয় আমাদের হবেই—আঁধার ঘোর কেটে আলো আসবেই