31 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, মে ৯, ২০২৪

বিশ্ব সাহিত্যের ভান্ডার মাইকেল মধুসূদন দত্ত

মোঃ আব্দুর রহিম বেনাপোল প্রতিনিধি
বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য নাম মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (২৫ জানুয়ারি ১৮২৪-২৯ জুন ১৮৭৩)। ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি, নাট্যকার এবং প্রহসন রচয়িতা। তাঁকে বাংলার নবজাগরণের কালজয়ী স্রষ্টা, ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ ও অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব গণ্য করা হয়। বাংলা সাহিত্যে তিনি এক অনন্য নাম। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের জনক, বাংলা সাহিত্যের নবযুগের অনিন্দ্যসুন্দর প্রতিভার অধিকারী, বাংলা ভাষার প্রথম আধুনিক কবি, অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবতর্ক এবং বাংলা কবিতার প্রথম বিদ্রোহী কবি। কবিতার বিষয় ও শৈলীতে তিনি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচনাকারী।
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ ‘মাইকেল মধুসূদন; প্রথম বিশ্বভিখারি ও ত্রাতা’ শীর্ষক বইতে লিখেছেন- ‘ মধুসূদন দত্তের সার্থকতা আকস্মিক বিস্ফোরণে, চারপাশে হঠাৎ তীব্র আলোকে ভরে দেয়ায়। তাঁর সংস্কারমুক্তি, বিশ্ব পরিব্রাজকতা, অতৃপ্তি তাঁকে ঠেলে দিয়েছিল হঠাৎ সফল হয়ে বিনাশের অভিমুখে ধাবিত হবার। ….তাঁর সংস্কারমুক্তি ঈর্ষা জাগায় আমাদের।’ তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। তিনি আজও সাহিত্যের আকাশে উদিত হয়ে আছেন এই সাহিত্যকে আলোকিত করে থাকা এক অনন্য উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে। তের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি এ সাহিত্যে এনেছিলেন ভিন্ন চিন্তা, কল্পনা ও সৃষ্টির এক সুবিশাল ঢেউ। তিনি এই সাহিত্যকে সবসময়ের জন্য তার কাছে ঋণী করে গেছেন। তাঁর লেখনীর দ্বারা সৃষ্ট সেই পথ ধরে পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যে যুক্ত হয়েছে অসংখ্য অনন্য সাধারণ সব নাটক, প্রহসন, কবিতা।
এই সাহিত্য আজও সমৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছে সেই স্রোতে, যে স্রোতের সৃষ্টি করেছিলেন মধুসূদন নিজে। কিন্তু সাহিত্যের এই মহৎ প্রাণের পথচলা মোটেও সহজ ও সুখকর কিছু ছিল না, বরং তার জীবন

কেটেছে মানসিক দ্বন্দ্ব, আপনজনের প্রত্যাখ্যান আর নিদারুণ দারিদ্র্যকে সঙ্গী করে। ৪৯ বছরের ছোট সেই জীবন ছিল একদিকে যেমন সৃষ্টিতে পরিপূর্ণ, অন্যদিকে দুঃখ, কষ্ট আর যন্ত্রণার এক অগ্নিপরীক্ষা। কলকাতা সদর দেওয়ানী আদালতের স্বনামধন্য উকিল রাজনারায়ন দত্ত ও জমিদারকন্যা জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান মাইকেল মধসুদন দত্ত মায়ের হাত ধরেই পরিচিত হন নিজ ধর্ম, দেব-দেবী, রামায়ণ, পুরাণ কিংবা মহাভারতের সাথে। আশ্চর্যের বিষয় হলো ছোটবেলাতেই বাংলা, সংস্কৃত ও ফারসি ভাষাসহ মোট ১৩টি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। এর ফলশ্রুতিতে ১৮৪৩ সাালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মধুসুদন নিরুদ্দেশ। বাতাসে একটি কথা শোনা যাচ্ছে তিনি নাকি খ্রিস্টান ধর্ম ও শ্রী বাদ দিয়ে মাইকেল নাম গ্রহণ করে নিজ কুল ও ধর্ম ত্যাগ করেছেন। এর ফলে তিনি হারিয়েছেন আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব এমনকি নিজ পিতামাতাকেও।
বাংলার ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে এই মহানায়কের জন্ম হয়। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের যুগপ্রবর্তক কবি। তিনি তাঁর কাব্যের বিষয় সংগ্রহ করেছিলেন প্রধানত সংস্কৃত কাব্য থেকে। কিন্তু পাশ্চাত্য সাহিত্যের আদর্শ অনুযায়ী সমকালীন ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালির জীবনদর্শন ও রুচির উপযোগী করে তিনি তা কাব্যে রূপায়িত করেন। যুগান্তকারী এই সৃষ্টির মধ্য দিয়েই বাংলা সাহিত্যে এক নবযুগের সূচনা হয়। উনিশ শতকের শুরুতে এ ভূখ-ে ঘটে নানা পরিবর্তন; বাংলার নবজাগরণের সে এক বিরাট শুভসময়! ইউরোপ-আমেরিকার শিক্ষা-সভ্যতা-সংস্কৃতি-ধর্ম-দর্শন-মানবতা-ইতিহাস প্রভৃতির তরঙ্গ প্রভাব ভারতবাসীর জীবনে দোলা দিয়ে সামগ্রিকভাবে আমূল পরিবর্তনের আভাস দিল। বাঙ্গালি পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে আত্মমুক্তি ও সংস্কারমুক্তির চিন্তা করতে লাগলো। শ্রী মধুসূদন সে জলবাতাসে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন; সেসব প্রবণতা আত্মস্থ করেছিলেন বেশ দ্রুত ও স্বাচ্ছন্দ্যে। এছাড়া উনিশ শতকী দেশপ্রেম আর স্বাধীনতা স্পৃহাও তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল প্রবলভাবে।

Journalist
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ধারণার ভারতীয় সংস্করণ, দেশমাতার প্রতি অমিত ভালোবাসা, মহাকাব্য রচনা, সনেট রচনা, পত্রকাব্য রচনা প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর চিন্তার প্রতিফলন এবং সৃজন-প্রয়াস বাংলা সাহিত্যভা-ারকে দান করেছে অভূতপূর্ব মর্যাদা ও সৌন্দর্য। এছাড়া বাংলা সাহিত্যে প্রথম সফল ঐতিহাসিক ও ট্র্যাজেডি নাটক (কৃষ্ণকুমারী ১৮৬১) এবং প্রথম মঞ্চসফল নাটক রচনার জন্যও তিনি সবিশেষ পরিচিত। তাঁর মেঘনাদবধ কাব্য (১৮৬১) বাংলা সাহিত্যের প্রথম এবং একঅর্থে একমাত্র মহাকাব্যের মর্যাদায় আসীন; পত্রকাব্য (বীরাঙ্গনা ১৮৬২) রচনায়ও তিনি দেখিয়েছেন পথপ্রদর্শকের প্রণোদনা।
উনিশ শতকের বাঙালি নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ মধুসূদন তাঁর অনন্যসাধারণ প্রতিভার দ্বারা বাংলা ভাষার অন্তর্নিহিত শক্তিকেই আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনন্য উৎকর্ষ সাধন করেন। একারণেই তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘মধুকবি’ নামে অমর হয়ে থাকবেন চিরকাল। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনের অন্তিম পর্যায়ে জন্মভূমির প্রতি তাঁর সুগভীর ভালোবাসার চিহ্ন রেখে গেছেন অবিস্মরণীয় পঙক্তিমালায়। তাঁর সমাধির গায়ে লেখা রয়েছে
‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহা নিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!’
একজন বিদগ্ধ, সচেতন, নিরপেক্ষ পাঠকমাত্রই জানেন যে, আমাদের বাঙালি রেনেসার কালজয়ী প্রতিভাবান শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে মধুসূদনের সৃজনশীল বৈচিত্র্যময় সাহিত্যে স্বদেশ চেতনার চিন্তাভাব ও ভাবনার ঐকান্তিক রূপ-রসের কত বেশি বিকাশ ঘটেছে। আর তাই সুদূর ভাসার্ই নগরে থেকেও কবি তার স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা, দেশের কথা, শৈশব জীবনের হাজারো মধুময় স্মৃতি এতটুকু ভুলে যাননি। সে জন্যই তিনি তার অমর সৃষ্টি ‘কপোতাক্ষ নদ’ শীষর্ক কবিতায় স্বদেশের একটি নদের জলকে গভর্ধারিণী জননীর দুগ্ধের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে প্রবল আবেগোপ্লুত হয়ে এভাবেই মনের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছেন
‘সতত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে,
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;
বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ স্রোতরূপী তুমি জন্মভূমি-স্তনে!’ (কপোতাক্ষ নদ)
আজ একথা দিবালোকের মতো সত্য যে, কালের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর প্রতিবাদী মুখ মহাবিদ্রোহী মহাকবি মধুসূদনের সমগ্র সাহিত্যে অর্থাৎ তার কি কবিতায়, কি নাটকে, কি প্রহসনে এবং কি তার মহাকাব্যে মূলত স্বদেশ চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধেরই সফল জাগ্রত রূপই প্রকাশ পেয়েছে।
‘জন্মভুমি রক্ষা হেতু কে ডরে মরিতে?
যে ডরে সে মূঢ় শতধিক তারে।’ (মেঘনাদবধ কাব্য)
আর এ কারণেই বাংলা সাহিত্য বলি কিংবা বাংলা কাব্য-মহাকাব্য যাই বলি না কেন, কবি মধুসূদনের কাছে ঢের বেশি ঋণী হয়ে আছে। মধুসূদনকে উপেক্ষা করলে বাংলা সাহিত্য, বাংলা কাব্য, বাংলা মহাকাব্য আপন শক্তিতে দাঁড়াবার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলবে। কাজেই যতদিন বাংলা সাহিত্য-কাব্য-নাটক ও মহাকাব্য থাকবে ততদিন মধুসূদন মহিরুহ হয়ে সৃজনশীলতার আলো ছড়াবে।
মাতৃভাষায় শিল্পসাধনার প্রেরণাদাত্রীকে কবি মধুসূদন কুললক্ষী বলে বিবেচনা করেছেন; তাঁর ধারণা শিল্পী-সাহিত্যিকরা ওই অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নির্দেশে বা অনুকম্পায় অথবা স্বপ্নাদেশবলে সৃজনশীল প্রতিভার প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হন। তাঁর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি বলেই কবির বিশ্বাস! বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য যে ভাবসম্পদ এবং স্মরণীয় ব্যক্তিত্বে সমৃদ্ধ, তা মধুকবির বুঝতে অসুবিধা হয়নি; রত্নরাজিতে পরিপূর্ণ বাংলাভাষার অমর সব কীর্তি এবং অসাধারণ সব প্রতিভার কথা মনে করেছেন
স্বপ্নে তব কুললক্ষী কয়ে দিলা পরে,-
‘ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে।
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃভাষা-রূপ খনি পূর্ণ মণিজালে।’ (বঙ্গভাষা)
মধুসূদনের বৈচিত্র্যময় অমর সাহিত্যে স্বদেশ চেতনার প্রতিফলন যেমন ঘটেছে তেমনি আবার তার সাহিত্য বাঙালি জাতীয়তাবোধকে জাগ্রত করেছে। নিজ ভাষাকে, সংস্কৃতিকে, স্বজাতিকে ও জাতীয়তাবোধকে প্রাধান্য দিয়েছেন বলেইতো কবি মধুসূদন পাশ্চাত্য শিক্ষা সাহিত্য সংস্কৃতি ছেড়ে আপনাকে বাংলাতে একাত্ম করে তুলেছিলেন। এজন্যই তিনি বাংলার নবজাগরণে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। বাংলা নবজাগরণের এই মহাকবির ১৯৬তম জন্মদিবসে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি

- Advertisment -

সর্বশেষ সংবাদ