নুর আলম সুমন, গোপালপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি,
টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার হাদিরা ইউনিয়নের সেনেরচর শাহসুফী সিনিয়র আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মোঃ মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে নিয়োগ বানিজ্য, চাকরি দেয়ার নামে প্রতারণার পর মিথ্যা মামলায় চাকরি প্রার্থীকে হয়রানি এবং প্রতিষ্ঠানের নানা খাতের অর্থ চুরি, হাত সাফাই ও আত্মসাতের নানা অভিযোগ আনা হয়েছে। মাদ্রাসার অধিকাংশ ষ্টাফ, এলাকার শিক্ষা হিতৈষি ব্যক্তিবর্গ এবং ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সদস্যরা লিখিত ভাবে এসব অভিযোগ তুলেছেন। শিক্ষা উপদেষ্টা, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, দুর্নীতি দমণ কমিশন, গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং গোপালপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস বরাবর লিখিত অভিযোগে নিরপেক্ষ তদন্ত এবং পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। গোপালপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস ইতিমধ্যে অভিযোগ তদন্তে নেমেছেন বলে জানা গেছে।
জানা যায়, ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সেনের চর শাহ সূফী মাদ্রাসা। ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠানটি এমপিও ভুক্ত হয়। লিখিত অভিযোগে প্রকাশ, অধ্যক্ষ মাওলানা মোঃ মনিরুজ্জামান ১৭ বছর আগে এক আওয়ামীলীগ নেতার পছন্দে ওই মাদ্রাসায় চাকরি পান। তারপর লীগ নেতাকর্মীদের যোগসাজশে দেড় যুগ ধরে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা চালানোর সুযোগ পান। তার স্বেচ্ছাচারিতার নেপথ্যে রসদ জুগিয়েছেন লীগ সরকারের প্রভাবশালি তিন নেতা। অভিযোগে দেখা যায়, ২০১৭ সাল থেকে শিক্ষকদের টিউশন ফি বাবদ উত্তোলন করা তিন লক্ষ পঁচাত্তর হাজার টাকা বিতরণ না করে আত্মসাৎ করেন তিনি। একইভাবে অষ্টম শ্রেণীর রেজিষ্ট্রেশন করার নামে বিপুল অঙ্কের ফি তুলে লোপাট করেন। ৬ষ্ঠ, ৮ম, ৯ম, ১০ম, আলিম এবং কারিগরী বিভাগের ভর্তি, রেজিষ্ট্রেশন, ফরম ফিলাপ, বাস্তব প্রশিক্ষণ এবং সনদ বিতরণ ফি ব্যাংকে জমা না রেখে নিজের পকেটে ভরেন।
তার বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ করা হয়, তিনি প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন সময়ে পাওয়া সরকারি বেসরকারি আর্থিক অনুদান যথাযথভাবে ব্যয় না করে ভুয়া বিল ভাওচারের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন। সোনালী ব্যাংক ধনবাড়ী উপজেলা শাখায় মাদ্রাসার নামে খোলা হিসাবের স্টেটমেন্ট থেকে তার আর্থিক অনিয়ম ও লেনদেনের তথ্য মিলে। তিনি টাকার বিনিময়ে কোন কোন স্টাফকে বছরের পর বছর ধরে অনিয়মিতভাবে ছুটি দিয়ে আসছেন। ফলে মাদ্রাসার লেখাপড়া ব্যাহত হচ্ছে। মাদ্রাসার অবকাঠামো জরাজীর্ন। এমনকি কোন কোন ক্লাসে চেয়ার টেবিল পর্যন্ত নেই। অধ্যক্ষের নিয়োগ বানিজ্যের সব চেয়ে বড় অভিযোগ করেছেন রহিমা খাতুন নামক এক চাকরি প্রার্থী। শিক্ষা উপদেষ্টার নিকট ভুক্তভোগী রহিমা খাতুনের দায়ের করা লিখিত অভিযোগ থেকে জানা যায়, তিনি ধনবাড়ী উপজেলার বন্দ চরপাড়া গ্রামের বাবুল হোসেনের স্ত্রী। গত ১৪.০২.২০১৪ তারিখে সেনেরচর শাহসূফী আলিম মাদ্রাসায় শূণ্য পদে একজন সহকারি গ্রন্থগারিক নিয়োগের জন্য দৈনিক খবর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। তিনি এ পদে নিয়োগের জন্য আবেদন করলে অধ্যক্ষ মনিরুজ্জামান জানান, টাকা না দিলে তার চাকরি হবেনা।
এমতাবস্থায় সেই সময়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হায়দার আলীর মাধ্যমে স্বামী বাবুল হোসেন এবং তিনি নিজে উপস্থিত থেকে অধ্যক্ষ মনিরুজ্জামানকে ১৭ লক্ষ ২০ হাজার টাকা প্রদান করেন। ১৩.০৪. ২০১৪ তারিখে অধ্যক্ষ তাকে নিয়োগপত্র প্রদান করলে তিনি যোগদান করেন। কিন্তু এমপিও ভুক্তির জন্য আবেদন করতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন তার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছিল ভুয়া। এমতাবস্থায় তিনি টাকা ফেরত চাইলে অধ্যক্ষ টালবাহানা শুরু করে। পরবর্তীতে চাপে পড়ে একশত টাকার স্ট্যাম্পে লিখিত প্রতিশ্রুতি এবং অধ্যক্ষের প্যাড়ে মুচলেকায় টাকা ফেরতের অঙ্গীকার করেন। কিন্তু পরবর্তীতে টাকা না দিয়ে আওয়ামীলীগ নেতাকর্মী দিয়ে হুমকিধামকি দিতে থাকেন। শুধু তাই নয়, এক পর্যায়ে বানোয়াট অভিযোগে আদালতে মিথ্যা মামলা দিয়ে ওই স্বামী-স্ত্রীকে হয়রানি শুরু করেন।
মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষক স্থানীয় সংবাদকর্মীদের নিকট অভিযোগ করেন, অধ্যক্ষ মনিরুজ্জামান দেড় যুগ ধরে লীগ নেতা কর্মীদের ব্যবহার করে নানা দুর্নীতি, অপকর্ম, নিয়োগ বানিজ্য এবং স্বেচ্ছাচারিতা করেছেন। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে নানাভাবে অপমান অপদস্ত করা হতো। তাই ভয়ে কেউ মুখ খুলতেন না। দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এখন তারা দুর্নীতিপরায় অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ তদন্ত এবং অপসারণ দাবি করছেন। এ ব্যাপারে মাওলানা মনিরুজ্জামানের সাথে সেলফোনে যোগাযোগ করলে তিনি সব অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা ও বানোয়াট বলে দাবি করেন। তিনি কোন অর্থ আত্মসাৎ করেননি। নিয়োগ বানিজ্য করেননি। কোন অনিয়ম করেননি। কারো বিরুদ্ধে তিনি মিথ্যা মামলাও দায়ের করেননি।
এ দিকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দায়ের করা দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে। গত বুধবার গোপালপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার জুলফিকার হায়দার অভিযোগ তদন্তে সেনের চর শাহসূফী আলিম মাদ্রাসায় গমণ করেন। তিনি অধ্যক্ষ, শিক্ষক, কর্মচারি এবং সাবেক কার্যকরি কমিটির একাধিক ব্যক্তির সাথে কথা বলেন এবং সার্বিক বিষয়ে খোঁজ খবর নেন। তিনি জানান,একদম নিরপেক্ষ তদন্ত হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। বাকি অভিযোগ আরো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সব কিছু বলা সম্ভব হচ্ছেনা।